আমার শিক্ষক দিবস।
আজকে ৫ই অক্টোবর ২০২৪ ইং শিক্ষক দিবস। তাই শিক্ষকদের নিয়ে সামান্য একটু লেখার জন্য নিয়ত করলাম। লেখাটি হবে একটি ছোট গল্প। গল্পটির নাম নির্ধারণ করা হয়েছে, আমার শিক্ষক দিবস।
পড়াশোনা করে যে গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে
মুর্খ যারা পরে তারা শুধু গাড়ির নীচে।
এই কথাটির সাথে পরিচিত নেই এমন মানুষ হয়তো খুজে পাওয়া সম্ভব না। ছোট বেলায় আমিও শুনেছি অনেক বার। সেই সাথে অনেকেরই মুখে শুনেছি লেখাপড়া করার সুফল। আবার অনেকের মুখে শুনেছি লেখা পড়া না করার জন্য আফসোস।
তখন সবে মাত্র একটু করে বুঝতে শিখেছি। সন্ধ্যে নামবে নামবে করছে হঠাৎ মা চিৎকার করে ডাক দিলো। ছুটে যেতে লাগলাম তার দিকে এবং তার কাছাকাছি যেতেই দেখি সে হাতে একটি বই নিয়ে দারিয়ে আছে। বইটির নাম একের ভিতর সব। আমি যাওয়া মাত্র ধরে নিয়ে পা ধুয়ে পরিষ্কার করে দিয়ে ল্যাম্প/হ্যারিকেন জ্বালিয়ে নিয়ে আমাকে পাশে নিয়ে বসে বইটি সামনে রাখলো। বইটিতে অনেক প্রকার ছবি ছিলো তাই পড়ার প্রতি বেশ আগ্রহ পেলাম। সেই সময় বইটি সব স্থানে ছিলো না কিন্তু বড় ভাই শহর থেকে এনে দিয়েছিলো। প্রথমে ছবি দেখিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করলো আমার মা, এইটা কি? এইটা কি? আমিও একটার পর একটা যেগুলো চিনতাম সেগুলো বলতে থাকি। এভাবে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় হাতের কাজ সেরে আমাকে নিয়ে বসে পড়াতে আরম্ভ করলেন। আলহামদুলিল্লাহ্ অল্প দিনের মধ্যেই বইটার সমস্ত পড়া আমার আয়ত্বে চলে এলো। এবং আমি একা একাই সব পড়তে পাড়তাম। এবং মাঝে মাঝে আমার বাবা আমাকে কোলে নিয়ে যথেষ্ঠ ভালো বাসা দিয়ে আমাকে পড়িয়েছেন। তিনি আমাকে সাথে নিয়ে নামাজ পড়তে যেতেন। আল্লাহর নামটিও তিনিই উচ্চারণ করতেন আমার সামনে অনেক বেশি যার ফলাফল হিসেবে আমিও আল্লাহ শব্দটির সাথে পরিচিত হয়ে যাই। আমার বাবা আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন আল্লাহর হুকুম আহকাম কি? পৃথিবীর জীবন ক্ষনস্থায়ী খুবই অল্প। আমাকে পাশে নিয়ে একটা গজল বলতো আমার বাবা। গজলটির দু একটি লাইন মনে আছে
“ডানে মাটি বায়ে মাটি শুধু মাটির বিছানা
উপর দিকে চায়া দেখি কাঁচা বাঁশের চালানা
আইছো একা যাইবা একা সঙ্গে কেউ তো যাবেনা”
তাই আমি বলতেই পারি আল্লাহ আমাকে পৃথিবীতে প্রেরণ করার পর আমার প্রথম শিক্ষক আমার বাবা এবং মা। তারাই আমার শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি দিয়েছে। আমার মা আমাকে বারবার বলতো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার যেনো না করি, মিথ্যা কথা যেনো না বলি, কাউকে যেনো গালি না দেই, বিপদে যেনো আল্লাহকে ডাকি। আর বাবা আমাকে নানান শিক্ষা দিয়েছেন যা বলে শেষ করা যাবে না।
আমার পারিবারিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের জন্য স্কুলে ভর্তি করানো হলো আমাকে। ছোট বেলায় কি কি পড়েছি সেখানে সব মনে না থাকলেও এটুকু মনে আছে আমি ছিলাম শিক্ষকদের চোখের মণি। আমাকে সকল শিক্ষক আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালোবাসতো। প্রাথমিক পর্যায়ে আমার শিক্ষক ছিলো মোঃ আব্দুস সাত্তার (প্রধান শিক্ষক), মোঃ আব্দুস সালাম (সহঃ শিক্ষক), মোঃ আব্দুল আজিজ (সহঃ শিক্ষক), মোছাঃ নিপা বেগম (সহঃ শিক্ষক)। এই প্রতিষ্ঠানটি নাম ছিলো দক্ষিন কাবিলপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানে আমি ৪র্থ শ্রেণী অবধি পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছি। এরপর নদী ভাঙ্গনের কারণে নিজ বাড়ি পরিবর্তন করে চলে আসি গোবিন্দগঞ্জ। এসে মদনপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। নতুন জায়গা নতুন স্কুল কাউকে চিনি না। দিন গুলো সব এলোমেলো কাটতে শুরু হলো। কেউ পরিচিত নাই, কেউকে চিনি না। দিন গুলো হলো একাকিত্বময়। ছোট মানুষ ওতসব বুঝি না। সবাই দেখি খেলাধুলা করে আমি একা একা বসে বসে থাকি। এরপর আলহামদুলিল্লাহ সময় পরিবর্তন হলো। দুইটি ছেলে নাম মোঃ পলক সরদার ও সোহাগ মন্ডলের সাথে একটি সম্পর্ক হলো। প্রথম সাময়িক পরিক্ষায় আমি সবার থেকে ভালো ফলাফল করার কারণে আমার সাথে সবার বন্ধুত্ব হলো। এবং তখন পরিচয় হলো আমার ক্লাসেই আমার দুইটি ভাগনি এবং মামাতো বোন পড়াশোনা করে। এরপর দিন ভালোই পার হতে থাকলো। প্রাথমিক পর্যায়ের এই শিক্ষকগুলোও আমাকে অনেক ভালোবাসতো এবং এখনও বাসে। তাদের নাম ছিলো মোঃ শাহারুল ইসলাম নান্নু (প্রধান শিক্ষক), মোছাঃ মমতাজ বেগম (সহঃ শিক্ষক), মোছাঃ টপি বেগম (সহঃ শিক্ষক), শ্রীমতি শীতা রাণী (সহঃ শিক্ষক)।
এরপর প্রাথমিক স্কুল জীবন শেষ হয় আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো ফলাফল হয়। এরপর আল্লাহর অশেষ রহমতে ভর্তি হই ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পার্শ্ববর্তী পিয়ারাপুর ইসলামিয়া গরিবুল্লাহ মন্ডল স্কুল এ্যান্ড কলেজ নামক একটি প্রতিষ্ঠানে। তারপর বিদ্যালয়ে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগলাম। ধীরে ধীরে আরও নতুন বন্ধু হলো আবার হলো নতুন নতুন প্রতিদ্বন্দী। শুরু হলো নতুন একটি জীবন। সেখানে পরিচিত হলো অনেক শিক্ষক যার মধ্যে সবথেকে বেশি ভালোবাসা দিয়েছেন জনাব শাহারুল ইসলাম মুরাদ, জনাব হারুনুর রশীদ, মোঃ নুরআলম, মোঃ গোলাম মোস্তফা, মোঃ আব্দুল লতিফসহ আরোও অনেকেই। এবং একই সাথে আমার কোচিং এর স্যার ছিলেন মোঃ সানোয়ার রহমান, যিনি আমার স্কুলের শিক্ষকও ছিলেন। সকলের ভালোবাসা পেয়ে আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো লাগতো।
(এছাড়া ৫ম শ্রেণিতে পড়ার সময় কোচিং করতাম কয়েকজন শিক্ষকের কাছে যারা আমাকে অনেক ভালোবাসতো এবং আমার ভালো রেজাল্টের পিছনে তাদেরও অবদান রয়েছে। মোঃ আব্দুর রশীদ, মোঃ আব্দুল হালিম, মোঃ রুবেল মিয়া এই তিনজন সহ আরও একজন হিন্দু শিক্ষিকা ছিলো যার নাম মনে নাই।)
৭ম শ্রেণিতে আমি ইংরেজিতে অনেক দুর্বল হয়ে যাই, তখন মোঃ নূরনবী স্যার (বর্তমান মৃত) আমাকে পরামর্শ দিয়ে আলমগীর কবির নামক একটি ছেলের কাছে যেতে বললো। আলহামদুলিল্লাহ তার কাছে যাবার পর গ্রামার সমস্যার সমাধান হয় এবং আমিও অন্যকে পড়ানোর মতো যোগ্যতাও অর্জন করি। আল্লাহ সর্বদা তার পাশে থেকে তাকে সঠিক পথের নির্দেশ দান করুন। ছেলেটি সত্যিই অনেক সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে তাকে এজন্য আমি মামা বলে ডাকতাম। এরপর অষ্টম শ্রেনীতে প্রাইভেট পড়ার জন্য আলমগীর কবির সাহেব পাঠিয়ে দিলেন আশরাফুল আলম স্যারের কাছে। যিনি আল্লাহর রহমতে গণিত বিষয়ে অনেক পারদর্শী ছিলো। তার কাছেও আমি হয়ে উঠি একজন সেরা ছাত্র। এরপর দোলন স্যারের কাছে ওখানেই ইংরেজি পড়ি এবং তারপর মিঠু স্যারের কাছেও ইংরেজি পড়ি। এবং সেই স্যার দুজনের কাছেও আমি অনেক প্রিয় ছিলাম। এরপর নবম শ্রেণীতে একজন শিক্ষকের সাথে পরিচিত হই যার নাম মোঃ আজিজার রহমান বিএসসি। তার জীবনের সবথেকে প্রিয় ছাত্রের কাতারে আমিও রয়েছি। তারসাথে আমার প্রথম পরিচয় ৬ষ্ঠ শ্রেনীর উদ্বোধন ক্লাসে। তিনি যে কয়টি প্রশ্ন করেছিলেন সব কয়টির উত্তর আমিই করেছিলাম। এরপর থেকে তার সাথে আমার সম্পর্ক হয়। এবং নবমে পা দিয়েই শুরু করি বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়া। এভাবেই স্কুল জীবনের পরিসমাপ্তি হয় ।
কিন্তু কলেজ জীবনে অনেক শিক্ষকের ভীড়ে আমি শিক্ষক পেয়েছিলাম ১ টা। সে হলো মোঃ মানিক মিয়া স্যার। এতোটা বন্ধুত্ব ও ভাতৃত্ব পূর্ণ ওনার সাথে না মিশলে বোঝা যাবে না। এই স্যারের সাথে থাকতে থাকতে শেষ হলো কলেজের এইচএসসি জীবন।
তারপর এখনো ভার্সিটিতে তেমন কোনো শিক্ষক পাইনি তবে যাদের পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ সকলেই ভাতৃত্বপুর্ণ। এছাড়াও সামজিক যে শিক্ষা, রাষ্ট্রীয় যে শিক্ষা সকল শিক্ষার অনেক বেশি দরকার রয়েছে। সকল ক্ষেত্রের সকল শিক্ষকদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করি। আল্লাহ সকলকে সঠিক পথে চলবার তৌফিক দান করুন। সকলকে ক্ষমা করে দিন।
আমার কাছে শিক্ষকের অর্থ হলো আল্লাহর নিয়ামত। তাদের সবসময় সম্মান করা উচিত। যিনি শিখাতে সকল কিছু বিসর্জন দিয়ে ছাত্রের কথা চিন্তা করে তারাই শিক্ষক। এবং যেনারা ছাত্রকে আল্লাহর রাস্তায় থাকার শিক্ষা প্রদান করে তারাই হলো সঠিক শিক্ষক।
No comments