মোটর আলীর হারানো ছায়া
মোটর আলীর হারানো ছায়া
দিনাজপুর রোড। তখনো বিশ শতকের শুনশান। গোবিন্দগঞ্জ থেকে বেইলি ব্রিজ পেরিয়ে কাটা। গোটা পাঁচেক চায়ের দোকান। আর, গজা-সিঙ্গারা-মিষ্টির কিছু। বাঁয়ে মোড় নিলেই উত্তরবঙ্গ চিনি কলের খামার। খরে যাওয়া মাটি। আঠারোশ একরের জমি। গাঢ় ইক্ষু-ছাওয়া বন যেন। উঁচুনিচু জমিতে কতক কাকচক্ষু জলের পুকুর। কেতাবে আর মুখে জায়গাটির নাম বাগদা ফার্ম। পাল, সেন, শাহী, মোগলাই যুগের ইতিহাস আছে এর। এখানেই ছিল বোগদহ বৌদ্ধ বিহার। লাল ট্রাক্টরে মাটি চষতে গেলে, সে সভ্যতার টুকরো হৃদয় আজও কলের লাঙলে টংকার তোলে যে।
আর লোকমুখে আনে বিভূতিবাবুর 'হীরে মানিক জ্বলে'র এডভেঞ্চার। পায়ে টানা ভ্যানে যেতে দিব্যি দুপুরেও গা ছমছম করে। ডাকাতের লাশ ফেলার ভয়। সামনে এগুলেই ফাঁসিতলা মোড়। মস্ত পাকুড়ের তলায় মোটর আলীর কুঁড়ে ঘর। কুঁজো মন্থরার মতো। বসত অর্থে ঘর তো নয়। “দোকান”। তবে লোকে ঘরই বলে। ছাউনিতে শরতবাবুর গফুরের ঘরের দুর্দশা। পচা খড় এই বুঝি খসে পড়ে পড়ে। আর, বাঁশের ছেঁচকিতে মাটির সাঁট দিয়ে তৈরি বেড়া। তিনদিকে। মেঝেতে হাত পড়ে না বহুদিন। নিকোনোর বালাই গেছে চুকে। রাতে ঘরটা পড়েই থাকে। এত নিঝুম যে শেয়াল কুকুরও বুঝি বসে না। সূর্য ঘাড়ের ওপর উঠতে উঠতেই পানের ভার কাঁধে মোটর আলী হাজির।
মোটর আলী। কেন এই নাম? আজ আর জানবার উপায় নেই। কালের করাল মারে সে ইতিহাস হারিয়েছে। ও কিংবদন্তির সেই বুড়ো। যার বয়েসের গাছপাথর নেই। কোমর নুয়ে পড়া বুড়িও বলে_ 'জন্ম থেকে ওমনই দেখছি ভাই।' মাথায় ব্যাকব্রাশ সাদা চুল। বুক অব্দি পাকা দাড়ি। খানিকটা মেটে রঙ ধরেছে। নীলাভ বাঙলা শার্ট। এই ঘরে বসে পান বেঁচেই পার হয় মোটর আলীর দিন। তবে সাধারণ পান নয়, মিঠে পান। সামনে গোটা পনেরো সীসার কৌটো। সেই মহৎ উপমা দেয়া যায়, তেঁতুল মাজা কাঁসা যেন। এতোটাই তকতক করে। সব রঙ-বেরঙয়ের মশলার ডিবে। শোনা যায় বগুড়া গিয়ে ফি মাসে মোটর আলী ওসব যুগিয়ে আনে। ও ঝুঁকে ঝুঁকে, এক মনে পান বানাচ্ছে। কোথাও খয়ের, কোথাও লাল সুপুরি, কোথাও লবঙ্গ গুড়ো, কোথাও মিহি জাউন, কোথাও লাল-সবুজ-হলুদ জড়িবুটি। কোনও কৌটোয় বা ঠাসা আছে পেপারমিন্ট। আর, ইয়া এক বাঁশের ডালায় সাঁচি পানের থোক। খিলি বাঁধা হয়ে গেল। এবার গায়ে লেপে দেয় ক্রিমের মতো একটা জর্দা। ছোট্ট কালো কৌটো থেকে। আলতো করে। খিলি তো নয়, যেন শিল্পগড়া। সে মৌজেই জানিয়ে দিলো বুড়ো_ মুখে নিয়ে চোষো, তারপর চিবোও। অন্যথা করলে তো_ পানের স্বাদ যাবে মরে।
মোটর আলী নিত্য ফাঁসিতলার এই খুপরিতে এসে বসে। সপ্তাহে দুদিন বিকেল অবিশ্যি ছাড় যায়, সেই দুইদিন পার্শ্ববর্তী বড় হাট/বাজার ফুলপুকুরিয়াতে উনি পান বিকাতে যেত। রাস্তা জুড়ে সাড়ে তিনটার ঝাঁকালো রোদ। মোটর আলী ভারে পান নিয়ে চলে ফুলপুকুরিয়া হাটে। রবি আর বুধবার। ডাক্তার নানার দোকানের পাশেই এক বারান্দায় সাজিয়ে বসে। তখনও বিদ্যুৎ আসেনি। সাঁঝে মোফার ডায়নামোর ঢিমে আলোয় বাজার ছেয়ে যেত। কিন্তু মোটর আলীর চেরাগ পিলসুজেই ভরসা। চলে পানের পসরা। বিরাম নেই। আড়াই টাকার ছোট পান, পাঁচ টাকার বড়ো পান। দিব্যি কিনছে ফুলপুকুরিয়ায় হাটুরেরা। আর ফাঁসিতলায় পায়ে টানা ভ্যানের যাত্রীরাই পান কেনে। তারপর ট্যাম্পু এলো। সিএনজি এলো। অটোরিকশা এলো। আদ্যিকালের ইট বিছানো পথে, পিচ পড়লো। চেরাগ-পিলসুজ-হারিকেন বিদেয় নিয়ে বাল্ব জ্বললো। কিন্তু মোটর আলী টিকে গেল। আশপাশের গাঁ থেকে কিছু লোক খামারে গরু চড়াতে আসে। ওর ঘরের ছায়ায় বসে আয়েশি গল্প ধরে। মোটর আলী কিন্তু মাতে না। বরং ভুল ধরিয়ে মাঝেমধ্যে আত্মবিশ্বাসী ফোঁড়ন দেয়। সব অতীতের গল্প, ওর থেকে কে জানবে ভালো? তাই ওমন বুকচেতা ভাব।
ছবিতে যে মোটর আলীকে ধরা গেছে, ওপরের গপ্পের সেই বাহার তাতে নেই। দীনতা ছেয়ে ফেলেছে শরীর ও উদ্যোম। দুকূলই। পায়ে নয়, চলতে হয় ভ্যানে। রূপোর মতো সীসার ঐ কৌটোগুলোও আর নেই। তা মেটাচ্ছে বাবা জর্দার ফাঁকা কৌটো। ফের বছর বিশেক চলে গেল যে। করোনার বিকেলগুলোয়, হামেশাই রাজু, ফুয়াদ, রিফাত, মামুন, তাসিন, আমি ওর দোকানে যেতাম। বসতাম। পান চিবুতাম আর গপ্পো শুনতাম। ফিল্ম-থিয়েটারের লোক মেহরাব জাহিদ ভাই শুনে বললেন_ ওকে নিয়ে একটা ছোট ডকুফিল্ম করি। কী বলো? আমরা প্রশ্রয় দিলাম। স্ক্রিপ্টও লিখে ফেললাম আমি। কাঠামোয় ফেললে মিনিট দশেক লাগে। ফিল্ম তোলার সরঞ্জাম সহ গিয়ে মোটর আলীকে সেদিন পাওয়া গেল না। হপ্তাখানেক বাদে জাহিদ ভাই ওর গ্রামে গেলেন। কিন্তু কপালের ফের। মোটর আলীর মেজাজ তখন খানিক বিগড়েছে। ফলে ফিল্ম তোলার সাহস ডিরেক্টর করলেন না। উদ্যোগ মারা গেল। আবার ব্যস্ত দুনিয়া। কাল গিয়েছে জলের মতো বয়ে। সদ্য দুদিনের অবকাশে বাড়ি গিয়ে এক কাণ্ড! দেখলাম বাপ পিতেমোর আমলের মোটর আলীর সেই ঘরটি আর নেই। ধূলিসাৎ হয়েছে। পাকুড় গাছটা কেবল ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। লোক পুছে একটা ব্যাপার জানা গেল, মোটর আলী বেঁচে আছেন। এর পেছনে যুক্তি হলো_ ওর চলে যাবার খবর তারা পাননি। কে বুঝবে_ মোটর আলীর ঐ ঘরের সাথে মাটিতে মিশে গেছে খাদ্য সংস্কৃতির এক ক্ষুদে পর্ব। কম করে তুললেও আশি বছরের ইতিহাস। তা আর মিলবে কিসে?
গল্পটি রচনা করেছেন Najmul Hasan Palak স্যার। অত্যান্ত সুন্দর করে লিখেছেন আলহামদুলিল্লাহ। গল্পটি ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করে এইস্থানে লিখলাম। আশা করছি গোবিন্দগঞ্জ ইতিহাসে এর থেকে বড় এবং বেশি সময়ের ইতিহাস আর কারো নেই। স্যার আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এই বৃদ্ধ দাদুর পানের কথা আবার মনে করিয়ে দেবার জন্য।
এই বৃদ্ধ মোটর আলী দাদু সম্পর্কে আমি নিজে যতটুকু জানি তা পড়তে নিচের লিংকটিতে ক্লিক করুন।
No comments