আদিবাসী/ ক্ষুদ্র জাতিসত্তা/ নৃগোষ্ঠি
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আদিবাসী পল্লী রয়েছে এখানে বসবাস করে নানা প্রজাতির মানুষ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আদিবাসী গোত্রের নাম হলোঃ চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, গারো, মুরং, খিয়াং, মণিপুরি, রাখাইন, লুসাই, খুমি, তঞ্চ্যঙ্গা ইত্যাদি। সংক্ষিপ্ত আকারে তাদের পরিচয় জেনে আসি।
চাকমা হলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্য ও উত্তরাঞ্চলেই তাদের প্রধান বসতি। তবে বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান সহ আরও কিছু স্থানে এদের বসবাস দেখা যায়। নিজেদের পরিচয় দিতে এরা চাকমা না বলে চাঙ্গমা বলতে বেশি পছন্দ করে। এরা সাধারণত কৃষি কাজ করে এবং এদের কৃষির প্রধান চাষাবাদ হলো জুম চাষ। এদের প্রধান ধর্ম হিসেবে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্ম। চাকমাদের সামাজিক ব্যবস্থা পিতৃপ্রধান। চাকমাদের সবচেয়ে বড় গোষ্ঠীগত উৎসব বিজু।
মারমা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর আদিবাসী জনগোষ্ঠী। মারমা জনগোষ্ঠির অধিকাংশই বাংলাদেশের তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়িতে বসবাস করে। এরা সাধারণত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মারমা জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় উৎসব সাংগ্রাই। এরাও পাহাড় কেটে কেটে জুম চাষ করে থাকে।
সাঁওতাল বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তাদের বাসস্থান মূলত রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া জেলার আশেপাশে। সাঁওতালদের প্রধান উৎসব সহরায়। সহরায় উৎসব হয়ে থাকে কার্তিক মাসে। তাই সাঁওতালি বর্ষপুঞ্জিতে কার্তিক মাসকে 'সহরায় বঙগা' বলে। সাঁওতালদের প্রধান ধর্ম খ্রিষ্টান হলেও অনেকেই আবার হিন্দু ধর্ম অনুসরণ করে থাকে। তারা খ্রিষ্টানদের বড়দিন সহ হিন্দুদের দুর্গা পুজো উৎসবও পালন করে থাকে।
গারো বাংলাদেশে বসবাসকারী একটি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী। টাংগাইল, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, গাজীপুর জেলায় এদের বসবাস দেখা যায়। গারোদের সমাজ ব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক। পরিবারে প্রধান হলেন মাতা। পরিবারের সন্তান-সন্ততিরা মায়ের পদবি ধারণ করে।ওয়াংগালা (ইংরেজি: Wangala) বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে বসবাসকারী গারো জাতির লোকদের প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। এটি ওয়ান্না নামেও পরিচিত। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসে গারো পাহাড়গুলোতে এই উৎসব তারা পালন করে থাকে। গারোরা প্রধানত খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী। তাদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মের নাম সাংসারেক, যা 'প্রকৃতি পূজারী' ধর্ম হিসেবে পরিচিত।
মুরং বাংলাদেশে বসবাস কারী এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। যাদের সংখ্যা অনেক কম। এরা পার্ব্যত্য অঞ্চলগুলোতে বসবাস করে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বপ্রাচীন নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি এবং বান্দরবান জেলার বসবাসকারী দ্বিতীয় বৃহৎ জাতিসত্বা। মুরং জাতিসত্তা ম্রো নামে পরিচিত। ম্রোরা আগে মায়নামারের আরাকান রাজ্যে বসবাস করত। আনুমানিক ১৪৩০ খ্রিঃ অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় ৫৯২ বছর আগে মুরং জাতিসত্তা বান্দরবান জেলার অন্তর্গত লামা, আলীকদম, থানছি ও নাই-ক্ষ্যাংছড়ি এলাকায় আশ্রয় নেয়। এবং পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। মুরংদের সাধারণ জীবন-যাপনে বৌদ্ধধর্মের অনুসরণ লক্ষ করা যায়। তবে এদের কিছু অংশ 'খিস্টান' ধর্ম পালন করে থাকে। এছাড়াও 'ক্রামা' নামের নতুন একটি ধর্মের অনুসরনও তারা করে থাকে।
খিয়াং পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসকারী একটি ক্ষুদ্র-নৃজাতি সত্তা। এরা দুইটি ধর্মের অনুসরণ করে থাকে। একটি হলো খ্রিষ্টধর্ম, অপরটি হলো বৌদ্ধ ধর্ম। যে সকল খিয়াং জনগোষ্ঠি খ্রিষ্টধর্ম অনুসরণ করে তারা নিজেদের খিয়াং বলেই পরিচয় দেয়। আর যে সকল জাতি বৌদ্ধধর্ম অনুসরণ করে তারা নিজেদের খেয়াং বলে পরিচয় দেয়। তবে খেয়াং এবং খিয়াং একসাথে উভয়ই নিজেদের পরিচয় দেয় হিয়োও নামে। বর্তমান বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম ও বান্দরবান জেলায় এ জাতিগোষ্ঠি বসবাস করে। এবং ২০১০ এর মতে তাদের সংখ্যা ২-৩ হাজারের মতো।
মণিপুরী বাংলাদেশের অন্যতম আদিবাসী/ক্ষুদ্র জাতিসত্তা। মণিপুরীরা খুবই ধর্ম ভীরু, এবং তারা হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। তাদের প্রাথমিক-হিন্দু ধর্মের উপাদান আজও সমাজে রয়ে গেছে। তারা হিন্দু দেবতাদের পূজা করার পাশাপাশি প্রকৃতির অন্যান্য অনেক দেবতারও উপাসনা করে-যার মধ্যে সাপ অন্যতম উল্লেখযোগ্য। রাসপূর্ণিমা উৎসব বাংলাদেশের মনিপুরী আদিবাসীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী উৎসব। প্রতি বছর কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব পালন করা হয়। উক্ত উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যার অন্যতম আকর্ষন হলো রাসনৃত্য।
রাখাইন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে বসবাস কারী একটি ক্ষুদ্র-জনগোষ্ঠী। রাখাইনরা আবার আরাকানি ও মগ নামেও পরিচিতি লাভ করেছে। রাখাইনদের আদিজাতি ছিলো মঙ্গোলীয়রা। রাখাইন জাতিসত্তারা বৌদ্ধধর্ম পালন করেন। তবে তাদের নিজস্ব নানান কৃষ্টি-কালচার আছে। তারা মারমাদের সাংগ্রাই উৎসবকে চৈত্র-সংক্রান্তিতে ধুমধাম করে পালন করে। রাখাইনরা বিভিন্ন পার্বণে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। এর মধ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান বিশেষ করে গৌতম বুদ্ধের জন্ম-বার্ষিকী, বৈশাখী পূর্ণিমা, বসন্ত উৎসব প্রধান। বর্তমানে রাখাইন সম্প্রদায়ের বসবাস মূলত কক্সবাজার, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায়। এ ছাড়া রাঙামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায়ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু রাখাইনের বসতি দেখা যায়। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায়ও রাখাইন সম্প্রদায়ের বসতি রয়েছে।
লুসাই নৃ-গোষ্ঠীর আদিবাস বার্মাতে বলে ধারণা করা হয়। ও তারা নিজেদের মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর বংশধর বলে পরিচয় দেয়। অতীতে লুসাইরা যার যার গ্রামে আলাদা করে নিজেদের মতো করে একেক নিয়মে বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করতো। পরবর্তীকালে লুসাইদের মধ্যে খ্রিস্টানধর্ম বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে ১০০% লুসাই খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। এরাও পার্ব্যত্য অঞ্চলগুলোতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে থাকে।
খুমি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে বসবাসকারী একটি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী। অতীতে এরা পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমার থেকে এসে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে বসবাস শুরু করে। তারা সাধারণত প্রকৃতির পূজা করে থাকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যানে ১৯৯৯ এর গণনা অনুসারে এদের মোট জনসংখ্যা ১২৪১ ছিলো।
তঞ্চ্যঙ্গ্যা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী একটি ক্ষুদ্র-নৃজাতিসত্তা। নৃজাতি জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যার দিক থেকে এদের স্থান বাংলাদেশে ৫তম। ১৯৯১ সালের আদমশুমারির হিসাব অনুসারে এদের মোট জনসংখ্যা ছিলো ২১,০৫৭ জন এবং পরিবার ছিলো ৪,০৪৩ টি। বৈসাবি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান ৩টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সমাজের বর্ষ-বরণ উৎসব। এটি তাদের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোর একটি হিসেবে তারা পালন করে থাকে। এই উৎসবটি ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুব, বৈসু বা বাইসু , মারমাদের কাছে সাংগ্রাই এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে বিজু নামে পরিচিত।
এসব ছাড়াও বাংলাদেশে আরও অনেক ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই বৈচিত্র বিশেষ করে ধর্ম বৈচিত্রই প্রধান এর পর আছে ভাষা বৈচিত্র। প্রতিটি জাতিসত্তার আলাদা আলাদা ভাষা রয়েছে যা বাংলাদেশের বৈচিত্রকে উজ্জলতায় পরিপূর্ণ করে।
No comments